মূসার জন্ম ও প্রথম জীবন
মূসার জন্ম মিশরে, এমন একটি সময়ে যখন ফেরাউন সমস্ত হিব্রু নবজাতক পুরুষ শিশুদের হত্যা করার আদেশ দিয়েছিলেন। মূসার মা, যোখেবেদ, তাকে তিন মাস লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু শিশুটির কান্না এবং অন্যান্য চিহ্ন থেকে বিপদের আশঙ্কা করে, তিনি তাকে নীল নদীতে একটি ঝুড়িতে রেখে দেন। ফেরাউনের মেয়ে ঝুড়িটি জলে দেখতে পেয়ে শিশুটিকে তুলে নেন এবং তাকে পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। ফেরাউনের মেয়ের কৃপায়, মূসার মা, যোখেবেদ, তার জন্য দুধমা হন এবং মূসাকে বড় করতে সাহায্য করেন।
মূসা মিশরের রাজদরবারে বড় হন এবং সেখানে শিক্ষিত হন। তিনি হিব্রুদের কষ্ট সম্পর্কে অবগত ছিলেন এবং তাদের মুক্তির জন্য মনস্থির করেন। একদিন, তিনি একজন মিশরীয়কে এক হিব্রু দাসকে মারধর করতে দেখে তাকে হত্যা করেন। এই ঘটনার পর মূসা মিশর ত্যাগ করেন এবং মিদিয়ানে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি যাত্রী হিসেবে জীবনযাপন করতে থাকেন এবং যেথ্রো নামক একজন পুরোহিতের মেয়ে সিপ্পোরাকে বিয়ে করেন। তাদের দুই সন্তান হয়।
জ্বলন্ত গুল্ম ও ঈশ্বরের ডাকে সাড়া
একদিন, মূসা হোরেব পর্বতে ভেড়া চরাচ্ছিলেন। সেখানে তিনি এক জ্বলন্ত গুল্মে ঈশ্বরের দেখা পান। গুল্মটি জ্বলছিল কিন্তু পুড়ে যাচ্ছিল না। এই দৃশ্য দেখে মূসা বিস্মিত হন এবং কাছে গিয়ে দেখতে চান। তখন ঈশ্বর তাকে ডেকে বলেন, "মূসা, মূসা!" মূসা উত্তর দেন, "আমি এখানে।" ঈশ্বর তাকে জানান যে তিনি তার পিতৃপুরুষদের ঈশ্বর, আব্রাহামের ঈশ্বর, ইসহাকের ঈশ্বর এবং যাকোবের ঈশ্বর।
ঈশ্বর মূসাকে মিশরে ফেরাউনের কাছে যেতে আদেশ দেন এবং হিব্রুদের মুক্তি দেওয়ার জন্য তাকে অনুরোধ করতে বলেন। প্রথমে মূসা দ্বিধাগ্রস্ত হন এবং বলেন, "আমি কে যে ফেরাউনের কাছে যাব এবং ইস্রায়েলীয়দের মিশর থেকে বের করে আনব?" ঈশ্বর তাকে আশ্বাস দেন যে তিনি তার সাথে থাকবেন এবং তাকে শক্তি দেবেন। তিনি আরও বলেন, "তুমি যখন আমার লোকদের মিশর থেকে বের করে আনবে, তখন তোমরা এই পর্বতের উপর ঈশ্বরের সেবা করবে।"
ফেরাউনের কাছে মূসার প্রথম সাক্ষাৎ
মূসা তার ভাই হারুনকে নিয়ে ফেরাউনের কাছে যান এবং বলেন, "ইস্রায়েলের ঈশ্বর প্রভু বলেছেন, আমার লোকদের ছেড়ে দাও যাতে তারা মরুভূমিতে আমার জন্য একটি উত্সব পালন করতে পারে।" কিন্তু ফেরাউন অস্বীকার করেন এবং হিব্রুদের কাজ আরও কঠিন করে দেন। হিব্রুরা মূসার কাছে অভিযোগ করে এবং মূসা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন। ঈশ্বর তাকে আশ্বাস দেন যে তিনি ফেরাউনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী হাত ব্যবহার করবেন এবং তার লোকদের মুক্ত করবেন।
দশ মহামারী ও মিশর থেকে মুক্তি
মূসা ও হারুন ফেরাউনের কাছে বারবার গিয়ে হিব্রুদের মুক্তি দেওয়ার অনুরোধ করেন, কিন্তু ফেরাউন প্রত্যাখ্যান করেন। তখন ঈশ্বর মিশরে দশটি মহামারী প্রেরণ করেন:
পানির রক্তে পরিবর্তন: মূসা তার লাঠি দিয়ে নীল নদীর জলকে রক্তে পরিণত করেন। মাছেরা মারা যায় এবং মিশরের লোকেরা জল পান করতে পারে না।
ব্যাঙের মহামারী: মিশরের সমস্ত স্থানে ব্যাঙেরা ছড়িয়ে পড়ে।
মশার মহামারী: মাটি থেকে মশারা বের হয়ে মানুষের এবং পশুর রক্ত শুষতে থাকে।
মাছির মহামারী: মিশরের ঘর-বাড়ি এবং মাটিতে মাছির দল আক্রমণ করে।
গবাদিপশুর মহামারী: মিশরের গবাদিপশুদের মধ্যে একটি মারাত্মক রোগ ছড়িয়ে পড়ে।
ঘা: মানুষ এবং পশুর শরীরে ফোঁড়া ও ঘা দেখা দেয়।
শিলাবৃষ্টি: শিলাবৃষ্টিতে মিশরের ফসল ও গাছপালা ধ্বংস হয়।
পঙ্গপালের আক্রমণ: পঙ্গপালের দল মিশরের সবুজ ফসল খেয়ে ফেলে।
অন্ধকার: মিশরে তিন দিন ধরে গভীর অন্ধকারে ঢাকা পড়ে।
প্রথম জন্মের মৃত্যু: মিশরের সমস্ত প্রথম জন্মের সন্তান ও পশুর প্রথম সন্তান মারা যায়।
এই শেষ মহামারীটির পরে ফেরাউন মূসাকে ডেকে বলেন, "তোমার লোকদের নিয়ে মিশর ছেড়ে যাও এবং প্রভুর সেবা কর।" মূসা ও হিব্রুরা মিশর থেকে বেরিয়ে পড়েন এবং লাল সাগরের দিকে যাত্রা করেন।
লাল সাগর পারাপার ও মিশরীয়দের ধ্বংস
মূসা ও হিব্রুরা লাল সাগরের তীরে পৌঁছালে ফেরাউন তার সেনাবাহিনী নিয়ে তাদের ধাওয়া করে। তখন ঈশ্বর মূসাকে আদেশ দেন তার লাঠি তুলে ধরতে। মূসা লাঠি তুলে ধরলে লাল সাগরের জল দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় এবং হিব্রুরা শুকনো মাটির ওপর দিয়ে পার হয়ে যায়। ফেরাউনের সেনাবাহিনী তাদের অনুসরণ করতে গেলে জল একত্রিত হয়ে যায় এবং মিশরীয়রা ডুবে যায়।
সিনাই পর্বতে ঈশ্বরের আইন প্রাপ্তি
মূসা হিব্রুদের নিয়ে সিনাই পর্বতে উপস্থিত হন। সেখানে ঈশ্বর তাদের সঙ্গে একটি চুক্তি করেন এবং দশ আজ্ঞা প্রদান করেন। এই আইনগুলো হিব্রুদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্দেশনা দেয় এবং তাদের ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে।
কাঞ্চন বাছুরের উপাসনা ও ঈশ্বরের ক্রোধ
মূসা যখন পর্বতে ছিলেন, তখন হিব্রুরা তার দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। তারা হারুনকে বলে যে তিনি তাদের জন্য একটি দেবতা তৈরি করুন। হারুন তাদের সোনার গয়না নিয়ে একটি বাছুরের মূর্তি তৈরি করেন এবং তারা সেই মূর্তিকে উপাসনা করতে শুরু করে। মূসা পর্বত থেকে নেমে এসে এটি দেখে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন এবং ঈশ্বরের কাছ থেকে প্রাপ্ত ট্যাবলেটগুলো ভেঙে ফেলেন। ঈশ্বরের আদেশে মূসা সেই মূর্তিকে গুঁড়িয়ে দেন এবং হিব্রুদের ওপর কঠোর শাস্তি দেন।
মরুভূমিতে চলার সময় ঈশ্বরের বিধান
মূসা হিব্রুদের নিয়ে মরুভূমিতে ৪০ বছর ধরে চলেন। এই সময়ে তারা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও বিপদে পড়ে। ঈশ্বর তাদের খাওয়ার জন্য মান্না ও কোয়েল পাখি প্রেরণ করেন এবং পিপাসার জন্য জল প্রদান করেন। তাদের অবাধ্যতা ও ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য তারা অনেকবার শাস্তি পান। তবে, ঈশ্বর তাদের প্রতি সদয় হন এবং তাদের নেতৃত্ব দিয়ে প্রতিশ্রুত ভূমির দিকে নিয়ে যান।
মূসার মৃত্যুর পূর্বে ভাষণ
মূসা, যাকোব ও ইয়োহন্নের মতো প্রাচীন পিতৃপুরুষদের থেকে ঈশ্বরের প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলেন যে তিনি তাদের সন্তানদের একটি নতুন ভূমিতে নিয়ে যাবেন। মূসা হিব্রুদের নেতৃত্ব দিয়ে সেই প্রতিশ্রুত ভূমি ক্যানানের দিকে যাত্রা করেন। কিন্তু, ঈশ্বরের আদেশ অনুযায়ী মূসা নিজে প্রতিশ্রুত ভূমিতে প্রবেশ করতে পারেন না। তিনি নেবো পর্বতে উঠে প্রতিশ্রুত ভূমি দেখেন এবং সেখানে মৃত্যুবরণ করেন।
দ্বিতীয় বিবরণ ৩৪:১-১২:
- "তখন মূসা মোয়াবের সমভূমি থেকে নেবো পর্বতে, পিসগা শীর্ষে উঠলেন, যা যেরিহোর বিপরীতে আছে। প্রভু তাকে সমস্ত দেশ দেখালেন—গিলাদ থেকে দান পর্যন্ত।"
- "মূসা প্রভুর আদেশ অনুযায়ী মোয়াব দেশে মারা গেলেন।"
- "মূসা যখন মারা গেলেন, তখন তার বয়স ছিল একশ বিশ বছর; তার চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়নি, তার শক্তি ক্ষীণ হয়নি।"
মূসার কাহিনীর গুরুত্ব
মূসার কাহিনী ঈশ্বরের নির্দেশনা, নেতৃত্ব, এবং বিশ্বাসের একটি মহান উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই কাহিনী থেকে ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিকতা নেওয়া হয়, যা বাইবেলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মূসার নেতৃত্বে হিব্রুদের মুক্তি, আইনপ্রাপ্তি, এবং প্রতিশ্রুত ভূমির পথে যাত্রা ঈশ্বরের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
মূসার কাহিনী বাইবেলে একটি মহান মুক্তির গল্প। ঈশ্বরের নির্দেশে, মূসা একজন নেতা হিসেবে হিব্রুদের মিশরীয় দাসত্ব থেকে মুক্তি দেন এবং তাদেরকে একটি নতুন জীবন ও প্রতিশ্রুত ভূমির পথে পরিচালিত করেন। এই কাহিনী ধর্মীয় বিশ্বাস, নৈতিক শিক্ষা, এবং মানবজাতির জন্য ঈশ্বরের পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত।
Comments
Post a Comment